হায়, জেরুজালেম তুমি কার!


গাজীউল হাসান খান

 


প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অর্থাৎ ১৯১৭ সালে ব্যালফোর ঘোষণাঅনুযায়ী ফিলিস্তিনি আরব ভূখণ্ডে ফিলিস্তিনসহ ইহুদিদের একটি পৃথক জাতীয় আবাসভূমি গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তখন ফিলিস্তিনসহ আরব উপদ্বীপের অধিবাসীরা এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। তেমন একটি অবস্থার মধ্যেই ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইহুদিরা ইসরায়েল নামে একটি রাষ্ট্র গঠন করেছিল। ফিলিস্তিনকে ইহুদিরা ধর্মীয় ও ঐতিহাসিকভাবে তাদের পূর্বপুরুষদেরপ্রতিশ্রুত ভূমিহিসেবে উল্লেখ করেছে বারবার। তারা দাবি করেছে যে প্রায় তিন হাজার বছর আগেও সেখানে তাদের একটি রাষ্ট্র ছিল, যার রাজধানী ছিল পবিত্র জেরুজালেমে। কিন্তু খ্রিস্ট জন্মের কিছুটা সময় পর থেকে সেখানে বিভিন্ন প্রশাসনিক কারণে রোম সম্রাটদের খড়্গহস্ত তাদের ওপর নেমে আসে। তখন থেকে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইহুদিদের জীবনযাপন ও পদচারণ কমতে কমতে একসময় তাদের কোনো অস্তিত্বই পরিলক্ষিত হতো না সেভাবে। সে দীর্ঘ সময়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ইহুদি সাধারণ মানুষকে প্রথমে খ্রিস্ট ধর্ম এবং তার অনেক পরে ইসলাম ধর্মেও দীক্ষিত হতে দেখা গেছে। যেহেতু পৃথিবীর কোথাও ইহুদি ধর্মাবলম্বী মানুষের কোনো নির্দিষ্ট রাষ্ট্র ছিল না, সেহেতু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই তারা তাদের আদি নিবাস ফিলিস্তিনে একটি হুইদি আবাসভূমি গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু ফিলিস্তিনসহ প্রতিবেশী মুসলিম অধ্যুষিত আরব রাষ্ট্রগুলো সে সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি। এতে আরব ও ইহুদিদের মধ্যে ১৯৪৮ সাল থেকে চারটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। জাতিসংঘের প্রস্তাবকে অগ্রাহ্য করে ইহুদিদের অব্যাহত ভূমি দখলের কারণে সে অঞ্চলের লাখ লাখ আরব বাসিন্দা তখন দেশত্যাগ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর (লেবানন, সিরিয়া, জর্দান ও অন্যান্য) শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। ফিলিস্তিনসহ আরবদের অনৈক্য ও দুর্বলতা এবং ইহুদিদের বিভিন্ন বাধার কারণে গত প্রায় ৭০ বছরেও ফিলিস্তিন সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। ইউরোপীয় বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশ ও বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত সমর্থনের কারণে ইহুদিরা প্রায় সমগ্র ফিলিস্তিনেই তাদের রাষ্ট্রের সীমানা ও প্রভাব বিস্তার করার নীলনকশা নিয়ে অত্যন্ত তৎপর হয়ে উঠেছিল। এ অবস্থায় ১৯৬৭ সালে ছয় দিনের এক হঠাৎ চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধে ইসরায়েলের আগ্রাসী বাহিনী পূর্ব জেরুজালেম ও গাজা উপত্যকাসহ সমগ্র ফিলিস্তিন দখল করে নেয়। সেই থেকে তারা শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যাটি সমাধানের লক্ষ্যে জাতিসংঘ ও বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য দেশগুলোর প্রস্তাব উপেক্ষা করে দখলকৃত ভূখণ্ডে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে বসতি স্থাপনের কাজ অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘ এ ভূখণ্ডে দুটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সে দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার সমাধানের কথা বারবার উল্লেখ করে আসছে; কিন্তু বাস্তবে কিছুই এগোয়নি।

পূর্ব জেরুজালেমসহ ১৯৬৭ সালের যুদ্ধপূর্ববর্তী আন্তর্জাতিকভাবে (জাতিসংঘ) স্বীকৃত সীমানার মধ্যে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের কথা সাব্যস্ত করা হয়েছিল। কিন্তু ইসরায়েলের ইহুদিবাদী সরকার গাজার হামাস গেরিলা বাহিনীর রকেট হামলাসহ বিভিন্ন নিরাপত্তাসংক্রান্ত কারণ দেখিয়ে বিষয়টি অমীমাংসিত রেখে দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ইসরায়েল নামক হুইদি রাষ্ট্রের নিরাপত্তার ওজর দেখিয়ে তারা ফিলিস্তিনের স্বীকৃত সীমানাজুড়ে অবৈধভাবে বসতি গড়ে সম্পূর্ণ বিষয়টিকে বিস্ফোরণোন্মুখ করে তুলেছিল। সে অবস্থায় সম্প্রতি জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বব্যাপী এক প্রতিবাদের ঝড় সৃষ্টি করেছেন। সবাই জানে জেরুজালেম নগরী দুই অংশে বিভক্ত এবং পূর্ব জেরুজালেমে ইসলামের তৃতীয় পুণ্যস্থান মসজিদুল আকসা (হারাম শরিফ) অবস্থিত। আল-কুদস নামে আরবদের কাছে পরিচিত পূর্ব জেরুজালেমে স্বাধীন ফিলিস্তিনের রাজধানী করার পূর্ব ঘোষণা ছিল। কিন্তু ট্রাম্পের ঘোষণায় পূর্ব কিংবা পশ্চিম কিছুই উল্লেখ না করে জেরুজালেম নগরীর নাম উল্লেখ করায় এক নতুন শক্তিশালী বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৪৭ সাল থেকে জেরুজালেম নগরী নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ১০টি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পাস করা হয়েছে। এতে জেরুজালেম নগরীর অবস্থানকে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে চূড়ান্ত আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণের (Final Statis) ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প সেগুলো পাশ কাটিয়ে ১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে গৃহীত এক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জেরুজালেমে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস স্থানান্তরের কথা ঘোষণা করে সমগ্র বিশ্বে এক আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। এর প্রতিবাদে সম্প্রতি তুরস্কের ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত বর্তমান ৫৭ সদস্যের ইসলামিক দেশগুলোর সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) এক জরুরি সভায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণার তীব্র নিন্দা জানিয়ে পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য বিশ্বব্যাপী আহ্বান জানানো হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সেই ঘোষণাকে অকার্যকর করার জন্য গত ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের ১৫ সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদে ওআইসির হয়ে সদস্য দেশ মিসর এক জরুরি সভা আহ্বান করে। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদে ১৪টি ভোট পেয়েও একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো প্রদানের ফলে প্রস্তাবটি শেষ পর্যন্ত পাস হয়নি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার কারণে সৃষ্ট বিতর্ক রয়েই গেছে। কারণ ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের পর থেকে পশ্চিম জেরুজালেমই ছিল তাদের সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। ইসরায়েলের সংসদ বা নেসেট, উচ্চ আদালত এবং এমনকি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনও করা হয়েছে পশ্চিম জেরুজালেমে। ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর বর্তমানে সমগ্র জেরুজালেমকেই কবজা করতে চায় সম্প্রসারণবাদী ইসরায়েল। তারা বলতে চায়, পুণ্য ভূমি জেরুজালেমকে বিভক্ত করা যাবে না। ডোনাল্ড ট্রাম্প যেহেতু তার ঘোষণায় জেরুজালেম বলতে পশ্চিম জেরুজালেমকে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেননি, তাতে ইহুদিবাদী ইসরায়েলিরা তাদের এক জেরুজালেম নগরীরদাবি নিয়ে নতুন করে আবার মাঠে নেমেছে। এতে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলকে কেন্দ্র করে যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, তাতে জ্বলন্ত আগুনে আরো ঘি ঢেলেছেন ইহুদিদের বন্ধু ডোনাল্ড ট্রাম্প।

ইসরায়েলের প্রতি পক্ষপাতিত্বের কারণে যুক্তরাষ্ট্র সমস্যাটির মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা হারিয়েছে। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ এখন আর মধ্যস্থতাকারী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে দেখতে চায় না। সে কারণে জাতিসংঘে নিযুক্ত ফিলিস্তিনের স্থায়ী প্রতিনিধি রিয়াদ মনসুর বলেছেন, পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানীসহ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনের স্বীকৃতির জন্য তিনি এখন অবিলম্বে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বিষয়টি উত্থাপন করবেন। ১৯৩ সদস্যের জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে কারো ভেটো দেওয়ার অধিকার নেই। সাধারণ পরিষদে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যই ফিলিস্তিনের সমর্থক। ইসরায়েলের ইহুদিবাদী নেতারা জেরুজালেমে তাঁদের আদি রাজধানী থাকার যে কাহিনি নতুনভাবে এখন বিশ্ববাসীকে শোনাচ্ছেন, তা সম্পূর্ণ তাঁদের মনগড়া। খ্রিস্টপূর্ব এক হাজার বছরে জেরুজালেমকে ইহুদি রাজা দাউদের রাজ্যের রাজধানী করা হয়েছিল। পরে তাঁর পুত্র সুলেইমানের সময়ে সেখানে তাদের প্রথম মন্দিরটি (ফার্স্ট টেম্পল) নির্মাণ করা হয়েছিল বলে জানা যায়। খ্রিস্টপূর্ব ৯৩০ বছরে দাউদ ও সুলেইমানের সে রাজ্য ভাগ হয়ে উত্তরে ইসরায়েল ও দক্ষিণে জুডা রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। তখন জেরুজালেম আর তাদের অবিসংবাদিত রাজধানী ছিল না। তা ছাড়া বৃহত্তর ফিলিস্তিনের অন্য আরো রাজ্যের মতো সে দুটি রাজ্যও সহাবস্থান করেছিল বলে জানা যায়। সে রাজ্যগুলো ইহুদি অধ্যুষিত ছিল না। বৃহত্তর ভৌগোলিক সংজ্ঞায় ফিলিস্তিন বলতে সমসাময়িককালের ইসরায়েল, ফিলিস্তিনের বিভিন্ন এলাকা, জর্দান, লেবানন ও সিরিয়ার কিছু অংশকে বোঝায়। যুগে যুগে এ জনপদে আল্লাহর বহু নবী-পয়গম্বর এসেছেন। হজরত ইবরাহিম, ইয়াকুব, মুসা, দাউদ, সুলেইমান, ঈসা ও মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁদের মধ্যবর্তী সময়ে আরো অনেকের পদচারণ ও কলকণ্ঠে প্রচারিত হয়েছে মহান স্রষ্টার অমোঘ বাণী। জেরুজালেমসহ ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমিতে সংঘটিত হয়েছে ইহুদি, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মের বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যার উল্লেখ আল্লাহ প্রদত্ত পবিত্র কিতাব তৌরাত, বাইবেল ও কোরআনে বিভিন্নভাবে রয়েছে। হিব্রু বাইবেল, খ্রিস্টান বাইবেল (ওল্ড টেস্টামেন্ট ও নিউ টেস্টামেন্ট) এবং পবিত্র কোরআনে এ অঞ্চলের বহু বর্ণনা পাওয়া যায়। এ অঞ্চলকে ল্যান্ড অব হিব্রুজপ্রমিজড ল্যান্ডএবং পবিত্র কোরআনে এ ভূমিকে আল-আরদ আল-মোকাদ্দাসঅর্থাৎ পবিত্র ভূমি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আল-কোরআনের সুরা মায়িদাহর ২১ নম্বর আয়াতে এ অঞ্চল সম্পর্কে আল্লাহ পাক উল্লেখ করেছেন যে মুসা (আ.) তাঁর সম্প্রদায়কে বলেছিলেন, ‘হে আমার কওম (বনি ইসরায়েল), প্রবেশ করো আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশিত এই পবিত্র ভূমিতে, পেছনে ফিরে যেয়ো না, অন্যথায় তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইসলামের আবির্ভাবের পর থেকে পবিত্র মক্কা নগরীতে অবস্থিত কাবা শরিফের দিকে নামাজের কিবলা পরিবর্তনের আগ পর্যন্ত জেরুজালেম বা বায়তুল মুকাদ্দাসই ছিল মুসলমানদের প্রথম কিবলা। পবিত্র মেরাজের রাতে অর্থাৎ আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের জন্য মহানবী মুহাম্মদ (সা.) এ জেরুজালেম থেকেই নভোমণ্ডলের উচ্চস্তরে সফর করেন। সে পবিত্র ভূমিতে পরবর্তী সময়ে খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান একটি মসজিদ নির্মাণ করেন (৬৯১ সাল), যা ডোম অব দ্য রকনামে খ্যাতি লাভ করেছে। তা ছাড়া এর এক দশক পর ইসলামের অপর খলিফা আল ওয়ালিদ-১ আল-আকসানামে আরেকটি প্রসিদ্ধ মসজিদ নির্মাণ করেন। তা ছাড়া আরব বদ্বীপের এ অঞ্চল বিজয়ের পর ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর বিন ইবন খাত্তাব জেরুজালেম সফরে এলে তাঁর হাতে নগরীর চাবি আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয়। পরে খলিফা ওমর (রা.) সেখানে একটি বিশাল মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। এর আগে ঈসা নবীর (যিশুখ্রিস্ট) অন্তর্ধানের পর জেরুজালেমে হলি সেপলকরনামে একটি গির্জা নির্মাণ করা হয়।

ভূমধ্য সাগর ও লোহিত সাগর সংলগ্ন এ সমৃদ্ধ অঞ্চলে পারস্য, গ্রিক, রোমান ও মিসরীয়সহ বহু সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উপর্যুপরি আগমন ঘটেছে। তারা এ জনপদে সাম্রাজ্য বিস্তার করে আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে যেমন বাণিজ্যকে সম্প্রসারিত করার চেষ্টা করেছে, তেমনি নৌঘাঁটি স্থাপন করে তাদের সাম্রাজ্যের অবস্থানকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিয়েছে বারবার। খ্রিস্টীয় যুগের দ্বিতীয় শতাব্দীতে প্রথম ও দ্বিতীয় ইহুদি বিদ্রোহের পর রোমান সম্রাট হাড্রিয়ান ইহুদিদের এ অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করেছিলেন। তা ছাড়া খ্রিস্টপূর্ব ৬০৪ সালে আসিরীয় সেনারা ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যের নির্দেশে বহুসংখ্যক ইহুদিকে ক্রীতদাসে পরিণত করেছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৬ সালে জুডা ব্যাবিলনীয়রা জয় করে নেয় এবং তারা জেরুজালেমে নির্মিত প্রথম ইহুদি মন্দিরটি ধ্বংস করে দেয়। পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৮ সালে এখানে পারস্যের সাম্রাজ্য বিস্তার লাভ করলে ইহুদিদের এ ভূখণ্ডে আবার ফিরে আসতে দেওয়া হয়েছিল। খ্রিস্টীয় যুগের আগে ও পরে, অর্থাৎ ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠী এ অঞ্চল শাসন করেছে। রোমের শাসন (খ্রিস্টপূর্ব ৬৩) এবং বাইজানটাইন শাসনকাল (৩৩০-৬৪০ সাল) এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এরপর ৬৩৮ থেকে একটানা ১০৯৯ সাল পর্যন্ত চলেছিল আরব খলিফাদের শাসন। তারপর আরবের মুসলমানদের দখল থেকে জেরুজালেম নগর উদ্ধারকল্পে শুরু হয়েছিল ইউরোপীয় খ্রিস্টানদের নেতৃত্বে ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ (১০৯৯-১১৮৭ সাল)। সে সময় ইউরোপীয় খ্রিস্টানরা এ অঞ্চল দখল করে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল। পরবর্তী সময়ে কুর্দি সেনানায়ক সালাহ উদ-দিনের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও যুদ্ধ পরিচালনার কাছে পরাজিত হয়েছিল খ্রিস্টান ধর্মযোদ্ধারা। ইউরোপীয়দের কাছেসালাদিননামে পরিচিত এ সেনানায়ক সিরীয় ও মিসরীয় মুসলিম শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে ১১৮৭ সালে ঐতিহাসিক হাত্তিনের যুদ্ধে সম্মিলিত খ্রিস্টান বাহিনীকে পরাজিত করে তাদের প্রিয় নগরী জেরুজালেমসহ অন্যান্য এলাকা দখল করেন। শেষ পর্যন্ত খ্রিস্টানদের প্রভাবশালী নেতা প্রথম রিচার্ড মুসলমানদের হাতে জেরুজালেমের সার্বিক নিয়ন্ত্রণভার তুলে দিয়ে পুণ্য ভূমিস্থাপনের খ্রিস্টীয় স্বপ্ন ত্যাগ করেন। এরপর এ অঞ্চলে পর্যায়ক্রমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তুর্কি (অটোমান), মিসরীয় এবং আবার তুর্কি শাসন, যা স্থায়ী হয়েছিল ১৯১৭ সাল পর্যন্ত। কিছুটা উত্থান-পতনসহ প্রায় এক হাজার ৩০০ বছর জেরুজালেমসহ এ অঞ্চল মূলত মুসলিম শাসনের অধীনে ছিল। সে সময়ে আরব মুসলিমরা জেরুজালেমসহ ফিলিস্তিনের স্থায়ী বাসিন্দায় পরিণতও হয়েছিল। তখন কোথায় ছিল আজকের জেরুজালেমের দাবিদার ইহুদিরা? তখন তারা মুসলিম শাসকদের দয়ায় এ অঞ্চলে বাস করেছিল। আর বাদবাকিরা ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে চলে যায় জীবিকার সন্ধানে। পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ বলশেভিক বিপ্লবের আগে থেকে তারাই আবার পাড়ি জমাতে শুরু করে আমেরিকায়। সেই ইহুদিরাই যখন প্রায় তিন হাজার বছর আগের ইতিহাস তুলে ধরে এখন জেরুজালেমের মালিকানা পেতে চায় তখন কোনো যুক্তি, আইন ও আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানই কাজ করে না। যুক্তরাষ্ট্রসহ ইহুদি জনগোষ্ঠীর বর্তমান অর্থবিত্ত ও প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং বিশেষ করে মার্কিন সমর্থিত সামরিক শক্তির কারণে ইহুদিবাদীরা জেরুজালেমসহ ইসরায়েল সম্পর্কে যেসব কথা বলে, বাস্তবে কিন্তু তা মোটেও ধোপে টেকে না।

সমগ্র জেরুজালেমসহ ফিলিস্তিন দখল করে মধ্যপ্রাচ্যে একটি শক্তিশালী ইহুদি রাষ্ট্র গড়ে তোলার ইসরায়েলি নীলনকশা বহুদিনের। ভূমধ্য সাগরের তীর থেকে জর্দান নদীর পশ্চিম সীমানা পর্যন্ত সে রাষ্ট্রের বিস্তৃতির লক্ষ্যে ইহুদিবাদীরা অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। তারা মনে করে, এ নীলনকশা বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্র তাদের সঙ্গে থাকলেই যথেষ্ট। ইসরায়েলের বাইরে বিশ্বে ইহুদিদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ঘাঁটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস কিংবা গণমাধ্যম থেকে শুরু করে ফেডারেল রিজার্ভ, ব্যাংকিং ব্যবস্থা, মুদ্রাবাজার বাণিজ্য ও বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানসবই ইহুদিদের নিয়ন্ত্রণে। যুক্তরাষ্ট্রের কোনো নির্বাচিত প্রেসিডেন্টই তাদের অসামান্য প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারেন না। তাহলে ক্ষমতায় টিকে থাকাই তাঁদের পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়াবে। সে কারণে ইহুদিরা ফিলিস্তিন সমস্যাকে ৭০ বছর ধরে ঝুলিয়ে রেখে ক্রমে ক্রমে গ্রাস করে নিচ্ছে তাদের সব ভূখণ্ড। শুধু তা-ই নয়, ইহুদিদের অসামান্য প্রভাব-প্রতিপত্তির কারণেই ডোনাল্ড ট্রাম্প তাদের হাতে রাখার জন্য জেরুজালেমকে ঘোষণা করেছে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে। এর পাশাপাশি রাজতন্ত্র এবং নিজেদের নিরাপত্তা রক্ষায় ইহুদিবাদী ইসরায়েলের খপ্পরে পড়েছে এখন সৌদি আরব। যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিমবিদ্বেষী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরায়েলের ইহুদিবাদী ধূর্ত প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এখন সৌদি রাজতন্ত্রের প্রধান উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করছেন। শুধু তা-ই নয়, ডোনাল্ড ট্রাম্পের কট্টর ইহুদিবাদী জামাতা জেরেদ কুশনার ও সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান মিলে ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানের নামে মুক্তিকামী ফিলিস্তিনিদের গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ আগ্রাসনবাদী ইসরায়েলের হাতে তুলে দিতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ফিলিস্তিনের মূল সমস্যা সমাধানের নিরপেক্ষভাবে মধ্যস্থতা করার আগেই জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে গিয়ে মাঝপথে ধরা পড়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেটি তাঁর জন্য হিতে বিপরীত হয়েছে। এ ঘটনায় পরস্পর বিবদমান মুসলিম দেশগুলো ও বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র এক হয়েছে ফিলিস্তিন এবং বিশেষ করে জেরুজালেম প্রশ্নে। তাদের সবার মুখে এখন একই কথাযুক্তরাষ্ট্র মধ্যস্থতাকারীর যোগ্যতা ও আস্থা দুটিই হারিয়েছে। সে অবস্থায় গত সোমবার জাতিসংঘে নিযুক্ত রাশিয়ার ডেপুটি রাষ্ট্রদূত বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যের, বিশেষ করে ফিলিস্তিন সমস্যার মধ্যস্থতাকারীর দায়িত্ব এখন রাশিয়ার ওপর অর্পণ করা উচিত। এ ব্যাপারে রাশিয়া অত্যন্ত নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে প্রস্তুত বলে তিনি জানিয়েছেন। বিশ্বপরিবেশ রক্ষা, বহুপক্ষীয় বাণিজ্য ও মুক্তবাজার অর্থনীতির সম্প্রসারণসহ বহু বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এখন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রায় একঘরে করে ফেলেছেন। অন্যদিকে সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রকে সাইডলাইনে ঠেলে দিয়েছেন। এখন আবার জেরুজালেমসহ ফিলিস্তিনের মুক্তির প্রশ্নে সারা বিশ্ব একদিকে আর যুক্তরাষ্ট্র ও তার বশংবদ ইসরায়েল একদিকে।

 

Comments

Popular posts from this blog

তালিবানদের হাতে ইউহান রেডলীর ইসলাম গ্রহন

তসলিমা নাসরিন এবং মুত্রমনাদের গোমর ফাঁস করে ছেড়ে দিলেন ন্যাংটা সাজু

৯/১১ এর হামলার জন্য কি ওসামা বিন লাদেন দায়ী?